ঈশ্বর গুপ্ত ও তাঁর কাব্য সক্রান্ত ইতিহাস (Part – 1)
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলাসাহিত্যের নবযুগের জন্মদাতা ছিলেন। তাঁকে যে অবস্থার মধ্যে সাহিত্যব্রতে আত্মনিয়োগ করতে হয়েছিল — তাঁর কাব্য নিয়ে আলোচনা করবার ক্ষেত্রে সেটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সে সময়কার বাংলা সাহিত্য মূলতঃ — রামায়ণ, মহাভারতের বঙ্গানুবাদ, বৈষ্ণবপদাবলী, মঙ্গলকাব্য ও দাশুরায়ের পাঁচালীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, ১৮১৮ সাল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত বাংলাসাহিত্য প্রধানতঃ সাময়িক পত্রিকার মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রথম যুগে — সমাচার দর্পণ, সম্বাদ কৌমুদী, সমাচার চন্দ্রিকা, বঙ্গদূত ও সংবাদ প্রভাকর — বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অজস্র সাহায্য করেছিল। অতীতের সেইসব সাময়িক পত্রিকার মাধ্যমেই — রাজা রামমোহন রায়, জয়গোপাল তর্ক‘লঙ্কার, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত — বাংলা গদ্যসাহিত্যের বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিলেন। ততদিনে বাংলা সাহিত্যে বৈদেশিক প্রভাব পড়তে শুরু করে দিয়েছিল। সেই কালের সমস্ত বাঙালী পাঠক–পাঠিকাদের মনে থাকা ইংরেজি সাহিত্যরসের প্রভাব কিভাবে পরিবেশন করা হয়েছিল — সেকথা সঠিকভাবে ইতিহাস থেকে জানা যায় না, তবে তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে সাহেবিয়ানার প্রবেশকে লক্ষ্য করে গুপ্তকবি একেবারে খাঁটি বাংলাভাষায় লিখেছিলেন —
“যত কালের যুবো যেন সুবো
ইংরাজী কয় বাঁকা ভাবে
ধোরে ওরু পুরুত মারে জুতো
ভিখারী কি অন্ন পাবে॥”
তৎকালীন সময়ে সাহিত্য সূচনা:
তখন বিশেষতঃ কাব্যরস প্রচার করবার জন্য ইঙ্গবঙ্গ মিশ্রিত একধরণের ভাষার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, এবং উপরোক্ত ধরণের রচনাগুলি সম্পূর্ণ প্রাচীন ধরণের ছিল না, সেগুলোতে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছিল, যেমন —
“হারিয়া লইবে শশী করিয়া ‘ফাইট’ (Fight)
মনে এই ভাবিয়াছ হইলে ‘নাইট’ (Night)
কেড়ে লবে আমাদের চাঁদের ‘রাইট’ (Right)
চলেছে নতুন কাল জ্বলেছে ‘লাইট’ (Light)”
এই ধরণের বিরাট পরিবর্তনশীল রচনার মধ্যে দিয়েই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তিনি খাঁটি বাঙালী কবি ছিলেন, আর সেই কারণেই বাংলা সাহিত্যে তিনি চিরস্মরণীয়। তাঁর সাহিত্য–জীবন নিয়ে আলোচনা করলে তাতে বাংলার সাহিত্যের মূলসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ঈশ্বর গুপ্তের ব্যক্তিত্ব নানাদিক থেকে অতুলনীয় ছিল। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি বাঙালীর সর্বাপেক্ষা প্রিয়কবির মর্যাদা পেয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, বাংলা আধুনিক গীতিকাব্য তখনও পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাব্যের ব্যঙ্গবিদ্রূপ, উপদেশদানে, বাস্তব দৃষ্টঘটনা ও লোকচরিত্র বর্ণনা করবার ব্যাপারে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত স্বাধীনজীবী ছিলেন, সাহিত্যচর্চা ছাড়া তাঁর অন্য কোন পেশা ছিল না। সেকালে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি সাহিত্যকেই নিজের একমাত্র পেশা বলে মনে করে বীজের জীবনযাত্রা নির্বাহ করেছিলেন; বলা বাহুল্য যে, সেদিক থেকেও তিনি সেই পথের প্রথম পথিক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সরস্বতী যে তখন ক্রমশঃ নিজের জীর্ণাসন ত্যাগ করে কমলার নতুন, সুন্দর ও ঐশ্বর্যময় আসন অধিকার করে নিয়েছিলেন — সেটার প্রকৃষ্ট প্রমাণ কবি ঈশ্বর গুপ্তের রচনায় দেখতে পাওয়া যায়। সেই সরস্বতী–কমলার যুগ্মপ্রসাদ তথা সাহিত্য–জীবিকা — বর্তমান যুগের বহু সাহিত্যিকের অনেকটাই অবলম্বন। কবি ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর নিজের প্রতিভা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার গুণে তৎকালীন জনসমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন, তিনি সাহিত্যসাধনা করা ছাড়াও ‘সংবাদ রত্নাবলী’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করবার ভার তাঁর নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরে কবি ঈশ্বরচন্দ্র দেশভ্রমণে ও তীর্থভ্রমণে গিয়েছিলেন। ভ্রমণ থেকে ফিরে আসবার পরে তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাহায্যে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা প্রকরণ করতে শুরু করেছিলেন। প্রথদিকে সেই পত্রিকাটি দু’দিন অন্তর প্রকাশিত হত। ১৮৫৩ সাল থেকে ঈশ্বর গুপ্ত প্রতি মাসে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন; তাতে গদ্য, পদ্য প্রভৃতি নানা বিষয়ের প্রবন্ধ স্থান পেয়েছিল। সেই কাগজেই তিনি বাংলার প্রাচীন কবিওয়ালা ও আখড়াইদের জীবনী ও গীতি প্রকাশ করেছিলেন। এর কিছুদিন পরে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবাদের পুনর্বিবাহের জন্য একটি পুস্তিকা লিখে প্রকাশ করেছিলেন, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তখন সেই প্রথাকে ব্যঙ্গ করে নানাধরণের কবিতা লিখে পাঠক–পাঠিকাদের, বিশেষভাবে বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধমতাবলম্বী পাঠক–পাঠিকাদের চিত্তরঞ্জন করেছিলেন। তাঁর সেই ধরণের একটি কবিতার নমুনা নিম্নরূপ —
“বিদ্যাসাগর নাহি তথা। কে কবে বিয়ের কথা॥
বিয়ে হলে বেঁচে যেত। সাধপুরে খেতে পেত॥
গহনা উঠত গায়। এড়াতো সকল দায়॥”
সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ এবং সেইসক্রান্ত তথ্য:
এরপরে ১২৫৩ সনে ‘পাষণ্ডপীড়ন’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। সেই পত্রিকাটির সঙ্গে গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য মহাশয়ের সম্পাদিত ‘রসরাজ’ পত্রিকাটির কবিতার লড়াই চলেছিল বেশ, এবং মাস দুই পরে উক্ত দুই পত্রিকাই বন্ধ হয়ে যায়। তাতে হতাশ না হয়ে ১২৫৪ বঙ্গাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সাধুরঞ্জন’ নামের আরেকটি পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেছিলেন। পত্রিকার জন্য সম্পাদকীয় কাজ করা ছাড়াও তিনি তৎকালীন কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বহু সভা–সমিতিতে (যথা — প্রকাশরঞ্জনী ও বঙ্গভাষা রঙ্গণী) নিজের রচিত কবিতা ও প্রবন্ধগুলি পাঠ করে জনসাধারণকে আনন্দদান করেছিলেন। এছাড়া তিনি নিজেও মফঃস্বলের কয়েকটি সাহিত্যসভার সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। সেগুলোর মধ্যে — তত্ত্ববোধিনী সভা, টাকীর নীতি তরঙ্গিণী সভা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সেকালের বহু সভায় তিনি সসম্মানে আমন্ত্রিত হতেন। বর্তমান সময়ের বহু সামাজিক অনুষ্ঠানে বা সভা–সমিতিতে সাহিত্যিকদের যে আমন্ত্রণ জানানো হয়, সেটার প্রথম নিদর্শন ঈশ্বর গুপ্তের জীবনে দেখতে পাওয়া যায়, এবং তিনিই সম্ভবতঃ ওই জাতীয় আমন্ত্রণের প্রথম প্রাপক ও বাহক ছিলেন। তাঁর সময় থেকেই সাহিত্যিকদের পদ–মর্যাদা ক্রমে ক্রমে বাড়তে এবং সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করতে শুরু করেছিল। এবারে গুপ্তকবির লেখা কয়েকটি কবিতার উদাহরণ দেওয়া যাক।
আটপৌরে ভাষায় উড়ন্ত ফানুস দেখে কবি বলেছিলেন —
“কেহ বলে দেখা যাবে এইখানে রই।
কেহ বলে এতক্ষণে হল চাঁদ সই॥
হেলেদুলে নেচেনেচে চলে থরে থরে।
মহাবেগে উঠিয়াছে মেঘের উপরে॥
উড়িয়াছে আকাশেতে সুচারু ফানস।
তাহাতে মানুষ বসে প্রফুল্ল মানস॥
সাবাস সাহস তার কিছু নাই ভয়।
যত উঠে তত মনে সুখের উদয়॥”
নিদারুণ গ্রীষ্মের কষ্ট বর্ণনা করতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন —
“দিশিপাতি নেড়ে যারা তাতে পুড়ে হয় সারা
‘মলাম, মলাম, মামু’ কয়।
হ্যাঁদু বাড়ী খানু ব্যাল, প্যাটেতে মাখিনু ত্যাল,
রাতি তবু নিদ নাহি হয়॥”
(পরবর্তী ভাগে সমাপ্ত, Part – 2)