ঈশ্বর গুপ্ত ও তাঁর কাব্য সক্রান্ত ইতিহাস (Part – 2, অন্তিম অংশ)
বাস্তববাদী কবি হিসেবে ঈশ্বর গুপ্ত:
ঈশ্বর গুপ্ত অতিবাস্তববাদী কবি ছিলেন। তিনি অশেষ গুণসম্পন্ন ছিলেন। সমাজসংস্কারের ব্যাপারে তিনি রক্ষণশীল মত পোষণ করতেন। তাঁর রচনার মধ্যে তিনি বহু জায়গায় অশ্লীল বা অসংযত ভাষা হয়ত ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু সেগুলির মধ্যেও সুস্পষ্ট মানবপ্রেম ও বাংলাভাষার প্রতি তাঁর অসীম অনুরাগ ও অকৃত্রিম ভক্তি প্রকট হয়ে উঠেছিল। কাব্যে পরিহাস পরিবেশন করবার জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালী কবি বলে গণ্য হয়েছেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের যে খাঁটি বাঙালীভাব বাংলা কবিতার সর্বাঙ্গে জড়িত ছিল, ‘গুপ্তকবি’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সেটার শেষ প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি সেকালের শেষ ও একালের সূচক ছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর বাল্যকালে গ্রামের পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়া করেছিলেন, কিন্তু খেলাধুলায় ও মুখে মুখে পদ্য রচনা করবার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। কথিত রয়েছে যে, ১৭/১৮ বছর বয়সে মাত্র দেড়মাসের মধ্যে তিনি সমগ্র মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহেশচন্দ্রও একজন স্বভাবকবি ছিলেন। কৈশোরে ঈশ্বরচন্দ্র নাকি তাঁর সঙ্গে কবির লড়াইতে মেতে উঠতেন। বাল্যকালেই তাঁর মধ্যে সহজাতপ্রতিভার প্রকাশ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল, এবং তাঁর সেই প্রতিভার পরিণত রূপ — ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার প্রকাশ ও সম্পাদনায় দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। সংবাদ প্রভাকরই বাংলার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র, এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তই সেই দৈনিক পত্রিকার প্রথম বাঙালী সাংবাদিক ছিলেন। পরবর্তী সময়ের অনেক সাহিত্যিকই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে একজন যুগস্রষ্টা হিসেবে এবং বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে মানবতার প্রথম পূজারী বলে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্তের বাংলা সংবাদপত্রের জগতে বিরাট অবদানও কম কিছু ছিল না। বর্তমান সময়ের সংবাদ–জগতে বিদগ্ধ ও জ্ঞানীগুণী মানুষের কলকাকলীর কোন অভাব না থাকলেও সেই প্রথম প্রভাতের স্নিগ্ধ বিহঙ্গ–কূজনটি কোনমতেই বলে যাওয়ার নয়। তাই সংবাদ প্রভাকরের চরাচর ব্যাপ্ত প্রতিভাকে চিরকালই নতুন করে স্মরণ করতে হবে। মানুষের হৃদয়ের সবসময়ের সব ভাবের অবস্থাকে তিনি কাব্যে রূপদান করবার চেষ্টা করেছিলেন; বলাই বাহুল্য যে, সবসময়ে সেটা হয়ত সুরুচিসম্মত হয়নি, কিন্তু সেইসব ত্রুটিসত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে — তাঁর হৃদয়বত্তা, চরিত্র–মাধুর্য এবং দেশপ্রেমের জন্য লেখা থাকবে। নিজের কীর্তির থেকেও তিনি বেশি মহৎ ছিলেন। গুপ্ত কবির দেশ বাৎসল্য কতটা তীব্র ও বিশুদ্ধ ছিল — সেকথা তাঁর দেশপ্রেমমূলক কবিতাগুলি পড়লেই বুঝতে পারা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মহৎ কীর্তির আরেকটি প্রমাণ হল — তাঁর ধর্মমতের উদারতার আন্তরিক অভিব্যক্তি। তিনি আদিব্রাহ্মসমাজভুক্ত হয়েও মহাকালীর স্তব রচনা করেছিলেন —
“শাস্ত্রে শাস্ত্রে তর্ক হয় কতজনে কত কয়
কিছু নয় সে সব বিচার।
জননী জনমভূমি ঈশের ঈশত্ব তুমি
একবস্তু সকলের সার॥”
জীবনের একটা সময়ে দৈনিক পত্রিকার দায়িত্ব আংশিকভাবে অপরের উপরে অর্পণ করে তিনি মাসিক পত্রিকার উপরই অধিকতর মনোযোগদিয়েছিলেন, এবং সেই সঙ্গে — ‘প্রবোধ প্রভাকর’, ‘হিতপ্রভাকর’ ও ‘বোধেন্দু–বিকাশ’ — নামক তিনটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত প্রতি বছর দুর্গাপূজার পরে দেশভ্রমণে বের হতেন, এবং সেই ভ্রমণকালে তিনি তৎকালীন দেশের সব গণ্যমান্য নেতাদের সঙ্গে মিলিত হতেন ও সাহিত্য আলোচনা করতেন। এইভাবে নিজের সময়ের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তিনি — রামপ্রসাদ, ভারতচন্দ্র, রামনিধি গুপ্ত, হরুঠাকুর, নিতাই বৈরাগী এবং আরো অন্যান্যদের জীবনী সংগ্রহ করে পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। ১২৫৭ বঙ্গাব্দ বা ১৮৫১ সালে তিনিই বঙ্গদেশে সর্বপ্রথম নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করেছিলেন।
অত্যধিক পরিশ্রম ও মস্তিষ্ক–চালনার ফলে একটাসময়ে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল; তবে সেই অবস্থার মধ্যেও তিনি শ্রীমদ্ভাগবতের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু মঙ্গলাচরণ ও কয়েকটি শ্লোকের বঙ্গানুবাদ করবার পরেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়ে গিয়েছিল।
দক্ষ কবি হিসেবে ঈশ্বর গুপ্ত:
ঈশ্বরচন্দ্র গদ্যেপদ্যে সমানভাবে দক্ষ ছিলেন, তবুও তাঁর গদ্যরচনার প্রতিভার থেকে পদ্যরচনা — অথবা, সাহিত্যপ্রতিভার থেকে কাব্যপ্রতিভা বেশি প্রখর ছিল। তাই সম্ভবতঃ কাব্য–রচনার ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর প্রতিভার উৎকর্ষ দেখিয়েছিলেন। এককথায় — সেযুগের খাঁটি বাঙালীর মনের ভাব, শুধুমাত্র ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যের মধ্যেই প্রতিভাত ও পরিলক্ষিত হয়। মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ — হলেন শিক্ষিত বাঙালীর কবি; আর ‘গুপ্তকবি’ ঈশ্বর গুপ্ত হলেন বাংলার কবি। যা কিছু আদর্শ, যা কিছু কমনীয়, যা কিছু আকাঙ্ক্ষিত — সেসব যেমন কবির সামগ্রী; তেমনি যা কিছু প্রকৃত, যা কিছু প্রত্যক্ষ, যা কিছু প্রাপ্ত — সেসবও কবির সামগ্রী। তাতেও প্রকৃত রস রয়েছে, সৌন্দর্য রয়েছে। কবি ঈশ্বর গুপ্তও তার ব্যতিক্রমী নন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত — বঙ্কিমচন্দ্র, রঙ্গলাল, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের সাহিত্যগুরু ছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েও সেকালের বাংলার এইসব প্রতিভাবান তরুণেরা ঈশ্বরচন্দ্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা সাহিত্যের সেবা করতে শুরু করেছিলেন; এটাকে গুপ্তকবির এক অলোকসামান্য প্রভাব বলা যেতে পারে। তিনি প্রভাকর পত্রিকায় নানাধরণের দেশাত্মবোধক কবিতা রচনা করে বাংলায় যে নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন, সেই প্রভাব আজও প্রসারিত রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের শুধু যুগান্তকারী কবিই নন, তাঁর রচনার বিষয় বস্তুতেও নিত্যনতুন ও সময়োপযোগী বিষয়, যেমন — ‘সব হ্যায় ফাঁক’, ‘খল–নিন্দুক’, ‘নির্গুণ ঈশ্বর’, ‘নীলকর’, ‘দুর্ভিক্ষ’ — প্রকৃতির সূচনা হয়েছিল। গুপ্তকবির রচনাগুলির শিরোনামাও বৈচিত্র্যময় এবং আকর্ষণীয়।
বর্তমান কালে ঈশ্বর গুপ্তের সাহিত্য নিয়ে বাঙালি:
বর্তমান সময়ে অনেকেই সুখে–দুঃখে ও আনন্দে–উৎসবে গুপ্তকবির ব্যঙ্গরচনার দু’-চার পংক্তি (লাইন) আবৃত্তি করে কৌতুক ও রস উপভোগ করে থাকেন। এযুগেও ব্যঙ্গ কবিতা রচিত হয়, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউ কি গুপ্তকবির মত সরল প্রাণ ও বাস্তববাদী রচয়িতা হতে পেরেছেন? একারণেই বঙ্গদেশে, সেকালের একজন অতিসামান্য পল্লীবাসী কবি হওয়া সত্বেও যথার্থ কাব্য–প্রতিভায় আলোকিত হয়ে রসিকের মানসাকাশে চিরভাস্বর শুকতারার মত স্নিগ্ধ, সুন্দর, প্রশান্ত নীলিমায় শোভা পাবে; গৌড় সুভাজনের মধ্যে কেউ সেই সৌন্দর্য, তো কেউ সেই দীপ্তি, আবার কেউ বা সমগ্র কাব্য তথা কবি–সৃষ্টি পুষ্পটির স্নিগ্ধরসসৌরভ কুড়িয়ে নেবেন। ঈশ্বর গুপ্তের সৃষ্টি–সম্ভার অনায়াসেই এই দাবি করতে পারে, কারণ — এই দাবী শুধু যথার্থই নয়, যুক্তিযুক্ত এবং বাঞ্ছনীয়ও বটে। এই দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার না করবার অর্থ হল সত্যের অপলাপ করা এবং বাঙালী হয়ে চির–অকৃতজ্ঞতার গ্লানিকে আজীবন বহন করা। কেননা ঈশ্বর গুপ্ত শুধু বাংলা সাহিত্যেরই কবি নন, তিনি সমগ্র বাঙালী জাতির , সমগ্র বাংলার কবি হয়েই আছেন।
(সমাপ্ত)