AHS

বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র ও পালি ভাষার ইতিহাস (Part – 1)

বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র পালি ভাষার ইতিহাস (Part – 1)

বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের যা কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা পাওয়া যায়, সেগুলোর প্রায় সমস্তই পালিভাষায় রচিত হয়েছিল। প্রাচীন পালি-সাহিত্যের একটা বৃহৎ অংশ জুড়েই বৌদ্ধদর্শন ও শাস্ত্র রয়েছে। সেই কারণে এই প্রসঙ্গে খুব সংক্ষেপে বৌদ্ধদর্শনের এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রীয় আচার-ব্যবহারের মোটামুটি একটি বিবরণের সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে, প্রাচীন পালি সাহিত্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা সম্ভব হবে।

বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা:

ভারতবর্ষের আর্যবংশীয়দের ইতিহাসকে যদি দুটি প্রধান ধর্মীয় ভাগে বিভক্ত করা যায়, তাহলে সেই দুটি বিভাগ হবে — হিন্দু ও বৌদ্ধ। আর্যদের ভারতের মূল ভূখণ্ডে আগমনের সময় থেকেই হিন্দুধর্মের সূচনা হয়েছিল বলা চলে, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম সেই সময়ের অনেক পর থেকে প্রচলিত ও প্রচারিত হয়েছিল। খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দীতে নেপালের কাছে অবস্থিত কপিলাবস্তু নিবাসী ক্ষত্রিয় কুলোদ্ভব রাজা শুদ্ধোদনের পুত্র গৌতমবুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গৌতমবুদ্ধ সংসারকে দুঃখময় বলে মনে করতেন, এবং সেই দুঃখ থেকে কিভাবে মানুষের পরিত্রাণ করা সম্ভব — সেটা অনুসন্ধান করবার জন্য তিনি সংসার ত্যাগ করেছিলেন। এরপরে তিনি কিভাবে যে ‘বুদ্ধ’ হয়েছিলেন —  সেই কাহিনী সম্পর্কে কমবেশি সকলেই অবগত রয়েছেন। বুদ্ধদেবের জীবনের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তিনি প্রয়াগের পূর্ব, বঙ্গদেশের পশ্চিম, হিমালয়ের দক্ষিণ ও গন্ডোয়ানায় উত্তর — এই চার সীমার মধ্যে থাকা — অযোধ্যা, মিথিলা, বারাণসী, মগধ — ইত্যাদি রাজ্যে নিজে অবস্থান করে নিজের ধর্মমত প্রচার করেছিলেন। তিনি পরম পুরুষার্থ অনুসন্ধান এবং সাধনাকাঙ্ক্ষী একটি উদাসীন সম্প্রদায় গঠন করেছিলেন; এবং তাঁদের ও অন্যান্য মানুষদের জন্য দু’রকমের আচার-আচরণ এবং ধর্মসাধনার পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। বৌদ্ধসম্প্রদায়ভুক্ত সেই উদাসীদের নাম ছিল — ‘ভিক্ষু’। অতীতে তাঁরা দলবদ্ধ হয়ে একত্রে ‘বিহার’ নামক একধরণের বাসগৃহে বসবাস করতেন। তবে তাঁদের প্রত্যেককে বাধ্যতামূলকভাবে বছরের মধ্যে কয়েক মাস যাবৎ বনবাস এবং গাছতলায় নিজের জীবনযাপন করতে হত। তাঁরা নিজেদের হাতে-বোনা ‘চীরপুঞ্জ’ পরিধান করে সেটার আবরণ হিসাবে একটি পীতবর্ণ আলখাল্লা ধরণের পোশাক ব্যবহার করতেন। তাঁরা নিয়মিত দাড়ি কামাতেন, মাথা মুড়োতেন, এবং স্ত্রীলোকের সংসর্গ, নৃত্যগীত ইত্যাদি সমস্ত রকমের ইন্দ্রিয়সুখপ্রদায়ক ব্যাপার থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতেন। তাঁরা সকলেই একাহারী ছিলেন। গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে তাঁরা দিনের আলো থাকতে থাকতেই একজায়গায় সমবেত হয়ে নিজেদের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতেন, এবং প্রায় উপবিষ্ট অবস্থাতেই রাতের বিশ্রাম ও নিদ্রা উপভোগ করতেন। সন্ন্যাসী হলেও তাঁরা গৃহস্থদের এবং সংসারের সঙ্গে নিজেদের সংযোগ রেখে চলতেন। ধর্মীয় উপদেশ দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন রোগে-ব্যাধিতে সাধারণ মানুষকে সেবা ও চিকিৎসা করাও তাঁরা নিজেদের পরম কর্তব্য বলে মনে করতেন। দান, ধ্যান, শীল, তিতিক্ষা, বীর্য, প্রজ্ঞা — এই ক’টি প্রধান বিষয়ের অনুষ্ঠানকে তাঁরা নিজেদের প্রধান কর্তব্য বলে গণ্য করতেন। সেইসব বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের অন্য দুটি নাম ছিল — শ্রমণ ও শ্রাবক; এবং বৌদ্ধগৃহীদের নাম ছিল — উপাসক ও উপাসিকা।বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র ও পালি ভাষার ইতিহাস (Part - 1)

নারীমুক্তিতে বৌদ্ধ ধর্ম :

বুদ্ধদেব নারীদের মুক্তির কথাও চিন্তা করেছিলেন, সেই কারণেই তিনি বৌদ্ধসম্প্রদায়ের নারীরাও যাতে ধর্মব্রত পালন করবার উদ্দেশ্যে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী সংসার ত্যাগ করে বৌদ্ধ আচার-আচরণের মাধ্যমে মুক্তিলাভ করতে পারেন — সেটার ব্যবস্থাও করেছিলেন। তাঁদের বলা হত — ভিক্ষুণী বা শ্রমণা। আচার আচরণের দিক থেকে রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নানদের সঙ্গে বৌদ্ধ শ্রমণাদের প্রভূত মিল দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন বৌদ্ধশাস্ত্র থেকে এরকম প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বুদ্ধদেবের জীবদ্দশাতেই শ্রমণাসম্প্রদায় গঠিত হয়েছিল। তবে শ্রমণদের থেকে শ্রমণাদের মর্যাদা কম ছিল। শ্রমণারাও শ্রমণদের মতোই বৌদ্ধধর্মীয় আচার-আচরণগুলি পালন করতেন। শ্রমণদের আদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ পালন করাও শ্রমণাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। তাঁরা কোন সময়েই বৌদ্ধশ্রমণদের উপদেশদান, তাঁদের নিন্দা বা তাঁদের প্রতি কোন ধরণের পরুষ বাক্য প্রয়োগ করতে পারতেন না। তাঁদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবার ব্যাপারেও বিভিন্ন বিধি-নিষেধ চালু ছিল। (Transactions of the Royal Asiatic Society, Vol. II, P: 491 & 495; Vol. VIII, P: 273 & 277; Asiatic Researches, Vol. VII, P- 42; Hardy’s Eastern Monachism, P: 6-165)

বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান বার্তা

আগেই বলা হয়েছে যে, গৌতমবুদ্ধ — গৃহী বৌদ্ধ এবং বৌদ্ধ শ্রমণদের জন্য দু’রকমের ধর্মীয় আচরণপদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন; এবং সত্য, অস্তেয়, অহিংসা ইত্যাদি স্বভাবসিদ্ধ ধর্মনীতির প্রাধান্য ঘোষণা করেছিলেন। বুদ্ধদেব বেদকে স্বীকার করেননি এবং তিনি বর্ণবিভেদও মানতেন না; কিন্তু তিনি তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণবিচার প্রথা রহিত করেছিলেন — এমন কোন প্রমাণও ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় না। তবে একথা সত্যি যে, তিনিই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি হিন্দু ভারতের বর্ণাভিমানকে খর্ব করেছিলেন। ইতর হোক বা ভদ্র, এমনকি অন্ত্যজবর্ণের মানুষেরা পর্যন্ত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের মতোই ভিক্ষু হতে পারতেন, কিন্তু বৌদ্ধদের মধ্যে সব সময়েই খুব সূক্ষ্মস্তরের বর্ণভেদ প্রচলিত ছিল বলে পণ্ডিতেরা ধারণা করে থাকেন। তবে তখন যেসব ব্রাহ্মণ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে বৌদ্ধবিহারগুলিতে প্রবেশ করেছিলেন, তৎকালীন বৌদ্ধশ্রমণ সমাজে তাঁদের কোন ধরণের আধিপত্য একেবারেই ছিল না।

বৌদ্ধ ধর্মের পুঁথি সংক্রান্ত ইতিহাস:

বুদ্ধদেব নিজের কোন লিখিত গ্রন্থ রেখে যাননি। তাঁর মৃত্যুর পরে বৌদ্ধদের চারটি মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রায় ৪৮৩ খৃষ্টপূর্বাব্দে রাজগৃহে প্রথম বৌদ্ধমহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এবং সেখানেই প্রথম বুদ্ধদেবের উপদেশ ও অন্যান্য বাণীগুলিকে সংকলিত করে বৌদ্ধশাস্ত্র তৈরী করা হয়েছিল। সেই শাস্ত্রের তিনটি ভাগ হল — সুত্তপিটক, বিনয়পিটক এবং অভিধম্মপিটক; এগুলিকে একত্রে — তিপিটক (ত্রিপিটক) — বলা হয়। বৌদ্ধশাস্ত্র ভোটভাষাতেও অনুবাদ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে সেই অনুবাদের কালবিস্তৃতি প্রায় সাতশো বছর ধরে — অর্থাৎ, খৃষ্টাব্দের সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল। ভোটভাষায় অনুবাদিত বৌদ্ধশাস্ত্রের নাম হল — কহ-গ্যুর এবং তন-গ্যুর। (ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়, ২য় খণ্ড, অক্ষয়কুমার দত্ত, উপক্রমণিকা, পৃ- ২৭৩) প্রথমটির মধ্যে ১,০৮৩টি গ্রন্থ সন্নিবিষ্ট করা হয়েছিল; সেগুলি কখনও ১০০টি, তো কখনও ১০২টি, তো কখনও আবার ১০৮টি বড় বড় খণ্ডে ভাগ করে নিয়ে মুদ্রিত করা হয়েছিল। এছাড়া — চীনাভাষা, মোঙ্গলভাষা এবং অন্যান্য ভাষাতেও সেগুলি মুদ্রিত করা হয়েছিল। প্রাচীন ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের বৌদ্ধরা বৌদ্ধশাস্ত্রগুলিকে পালি এবং সিংহলী ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন, এবং সেখান থেকে বৌদ্ধশাস্ত্রগুলি শ্যাম, কম্বোজ, ব্রহ্মদেশ, জাভা, বালি, সুমাত্রা, জাপান প্রভৃতি দেশে সেইসব দেশের ভাষায় অনুবাদিত হয়ে প্রচারিত হয়েছিল। ‘মহাবংশ’ গ্রন্থের সাক্ষ্যকে মেনে নিলে একথা স্বীকার করতেই হয় যে, বুদ্ধদেব নির্বাণলাভ করবার ৯৫৩ বছর পর থেকে ৯৭৫ বছর পর্যন্ত, অর্থাৎ — ৪১০ খৃষ্টাব্দ থেকে ৪৩২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত, — বুদ্ধঘোষ সিংহলী ভাষায় বিরচিত ‘অত্থকথা’ গ্রন্থটি পালি ভাষায় অনুবাদ, এবং ‘পিতকত্তয়ের’ (পিটকত্রয়ের) ভাষা সংগ্রহ ও ‘নানোদয়’, ‘অত্থশালিনী’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সিংহলের শাসক ধাতুসেনের কাকা — মহানাম — উক্ত মহাবংশ গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন। ৪৫৯ খৃষ্টাব্দ থেকে ৪৭৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ধাতুসেনের রাজত্বকাল ছিল। সেই কারণেই গবেষকরা মনে করেন যে, বুদ্ধঘোষের অনুবাদ এবং অন্যান্য গ্রন্থগুলির রচনা মহানামের রাজত্বকালেই হয়েছিল। যেহেতু মহানামের রাজত্বকালেই বুদ্ধঘোষের সমস্ত গ্রন্থাদি প্রণীত হয়েছিল, সেজন্য মহানামের সাক্ষ্যকে পণ্ডিতেরা অধিকতর প্রমাণিক বলে মনে করে থাকেন। (Introduction to Buddhaghosa’s Parables, Translated by Captain T. Rogers, Max Muller, p: X-XXIV)

(পরবর্তী ভাগে Part – 2)

Leave a Comment