AHS

বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র ও পালি ভাষার ইতিহাস (Part – 2)

বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র পালি ভাষার ইতিহাস (Part – 2)

ঈশ্বর ভাবনায় বৌদ্ধ ধর্ম:

প্রাচীনতম বৌদ্ধসম্প্রদায়ের শ্রমণরা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করতেন না। তাঁদের মত ছিল যে, — জড়পদার্থ নিত্য, ও সেই জড়পদার্থের শক্তিতেই সবকিছু সৃষ্টি হয়ে থাকে। মধ্যে মধ্যে প্রলয় ঘটলে ওই জড়ের প্রভাবেই বা জড়ের অন্তর্ভুক্ত গুণের প্রভাবেই পুনরায় সৃষ্টি হয়। পরে নেপালে বৌদ্ধদের একটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল, তাঁরা একটি আদি-বুদ্ধের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। (Asiatic Researches, Vol. XVI, P- 441; Bouddhisme Indien, Vol. I, Burnouf. P- 119) সেই আদিবুদ্ধ ছিলেন — নিত্য, নিরাকার, জ্ঞানবান, দয়াবান ও ন্যায়বান; সেই সম্প্রদায়ের মতে তিনি স্বতন্ত্ররূপ, এবং তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর সমস্ত ক্রিয়াগুলি সম্পন্ন করে থাকেন। বৌদ্ধধর্মের সেই সম্প্রদায়কে এক হিসাবে আস্তিক বলা চলে। তাঁদেরও আবার দুটি ভাগ ছিল। তাঁদের মধ্যে একদল বলেছিলেন যে, প্রথমে শুধুমাত্র সেই আদিবুদ্ধই ছিলেন, এবং তিনি ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। অন্যদিকে দ্বিতীয় দলটি বলেছিলেন যে, প্রথমে আদিবুদ্ধ যেমন ছিলেন তেমনি জড় পদার্থের অস্তিত্বও ছিল। সেই আদিবুদ্ধ তাঁর নিজের ইচ্ছা অনুসারে আত্মস্বরূপ থেকে অন্য পাঁচটি বা সাতটি বুদ্ধকে উৎপাদন করেছিলেন। তাঁরা হলেন — ধ্যানীবুদ্ধ। এরপরে সেই ধ্যানীবুদ্ধদের থেকে আরও পাঁচটি বা সাতটি বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন, তাঁরা হলেন — বোধিসত্ত্ব। তাঁরা প্রত্যেকে পর্যায়ক্রমে জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন। কিন্তু সিংহলের বৌদ্ধরা সর্বতোভাবে নাস্তিক ছিলেন। অন্যদিকে নেপাল, ভুটান ও চীনের বৌদ্ধরা আদিবুদ্ধ, ধ্যানীবুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব এবং অন্যান্য দেবদেবী তো বটেই, — এমনকি হিন্দু শাস্ত্রেরও নাগ, কিন্নর, গন্ধর্ব ইত্যাদিতে বিশ্বাস করতেন। তাই অতীতে তাঁরা বুদ্ধদেবের যেসব জীবনবৃত্তান্ত রচনা করেছিলেন, সেগুলিতে বারবার এসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সিংহল ও ব্রহ্মদেশের বৌদ্ধরা আজও এসব কিছুই মানেন না।বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র ও পালি ভাষার ইতিহাস (Part - 2)

বৌদ্ধ ধর্ম এবং হিন্দু ধর্ম:

বৌদ্ধরা কিন্তু হিন্দুদের মতোই নিজের নিজের কর্ম অনুযায়ী বারবার যোনিভ্রমণ ও স্বর্গনরক ভোগ করাকে বিশ্বাস করে থাকেন। দু’রকমের অনুষ্ঠান অনুসারে তাঁদের মধ্যে দুটি শাখার উৎপত্তি হয়েছিল — হীনযান ও মহাযান। হীনযানীরা সাংসারিক অর্তব্য-অকর্তব্য অনুশীলন করে স্বর্গকামনায় সংযম, উপবাস ইত্যাদির অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন, অন্যদিকে মহাযানীরা নির্বাণ লাভ করবার জন্য আত্মজ্ঞানের অনুশীলন ও ধ্যানযোগের অনুসরণ করে থাকেন। তাঁদের ‘ভাবনা’ নামের একরকমের শুভচিন্তার কথা প্রাচীন বৌদ্ধশাস্ত্রগুলিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সিংহল থেকে প্রকাশিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধশাস্ত্রগ্রন্থে পাঁচ রকমের ভাবনার কথা দেখতে পাওয়া যায়, যথা — মৈত্রী, করুণা, মুদিত, অশুভ ও উপেক্ষা। মানুষ হোক কিংবা দেবতা — সবাই সুখী হোক, সকলেই রোগ, শোক ও নিজেদের অসৎ প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হোক, এমনকি নরকবাসীরাও সুখী হোক — এই ভাবনার নাম হল ‘মৈত্রী’ ভাবনা। দুঃখীর দুঃখহরণ হোক, তাঁদের যথেষ্ট পরিমাণে অন্নবস্ত্র লাভ হোক — এই ভাবনার নাম হল ‘করুণা’ ভাবনা। ভাগ্যবান ব্যক্তির সৌভাগ্যসম্পদ স্থায়ী হোক, এবং প্রত্যেকেই নিজের নিজের কর্মানুযায়ী শুভ ফল লাভ করুক — এই ভাবনার নাম হল ‘মুদিত’ ভাবনা। মানব শরীর বিদ্যুৎলতার মত অস্থায়ী এবং মরীচিকার মত অসৎস্বরূপ ও মূত্র-পুরীষে পূর্ণ ঘৃণিত বস্তু — এই ভাবনার নাম হল ‘অশুভ’ ভাবনা। মহাযানীদের মতে এই ভাবনা হল নির্বাণ নগরীর দ্বারস্বরূপ। পৃথিবীর সমস্ত জীবই সমান, কেউই কোন প্রাণীর থেকে অধিকতর প্রীতি বা ঘৃণার পাত্র নয় — এই ভাবনাই হল ‘উপেক্ষা’ ভাবনা। বৌদ্ধশাস্ত্রে এমন বিধানও দেওয়া হয়েছে যে, ভিক্ষুরা ঊষা বা সন্ধ্যায় নির্জনে বসে ভাবনা করবেন। (Eastern Monachism, Hardy, P: 243-252)

যানশব্দের তাৎপর্য

‘যান’ শব্দটি নিয়েও আলোচনা করবার প্রয়োজন রয়েছে। জীবাত্মার উত্তরোত্তর উৎকর্ষসাধনের সোপান পরম্পরার নামই হল — ‘যান’, চীনা ভাষায় এটিকে — ‘চিঙ্গ’ — বলা হয়। চীন দেশের বৌদ্ধ সমাজে সচরাচরভাবে তিন রকমের যান স্বীকৃত রয়েছে; সেখানে শ্রাবক বা শ্রমণেরা হলেন প্রথম যান, প্রত্যেক বুদ্ধেরা হলেন দ্বিতীয় যানস্থ এবং বোধিসত্বেরা তৃতীয় যানের অন্তর্গত। তাঁরা এক এক রকমের যানের সাধনার দ্বারা উত্তরোত্তর ঐ পদগুলি প্রাপ্ত হন। আবার কেউ কেউ বলেন যে, যান হল পাঁচটি — মানুষেরা হল প্রথম যান, দেবতারা হলেন দ্বিতীয় যান, শ্রাবকেরা হলেন তৃতীয় যান, প্রত্যেক বুদ্ধেরা চতুর্থ এবং বোধিসত্ত্বেরা পঞ্চম যানস্থ। তাঁদের মতে মানুষ এবং দেবতারা হীনযান; শ্রাবকেরা দ্বিতীয়, প্রত্যেক বুদ্ধেরা তৃতীয়, বোধিসত্ত্ব চতুর্থ এবং বুদ্ধেরা পঞ্চম বা মহাযানস্থ। হীনযানীরা মনে করেন যে, সংসার যন্ত্রণাময়; স্নেহ-মমতা ইত্যাদিই সেই যন্ত্রণার মূল। সেজন্য সমস্ত দুঃখের মূল — এই স্নেহ-মমতা ইত্যাদি ধ্বংস করা নিতান্তই আবশ্যক। একমাত্র ধ্যানের মাধ্যমেই  সেইসব বিনষ্ট হতে পারে। আর যদি সেটা করতে পারা যায়, তাহলে নির্বাণরূপ পরমপুরুষার্থ লাভ করা যাবে। এটাই হল হীনযান সাধকদের জীবনের পরম লক্ষ্য। হীনযানরা মনে করেন যে, ধ্যানবলই হল প্রধান বল; — স্বয়ং গৌতমবুদ্ধ নিজে এমন ধ্যানে সমারূঢ় ছিলেন যে, কি দেবতা কি মানুষ — কেউই কখনও তাঁর মত সেরকম ঘোরতর ধ্যান বা তপস্যায় নিবিষ্ট হতে পারেন নি। দেবতা ও মানুষেরা হীনযান সাধনা দ্বারা নরকবাস এবং অসুর দৈত্য ও ইতরজন্তুর যোনিপ্রাপ্তি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে থাকেন। শ্রাবক, বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বেরা তাঁদের নিজের নিজের পদোচিত বিশেষ বিশেষ সাধনার দ্বারা ত্রিলোক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে থাকেন। চরম — অর্থাৎ, মহাযান সাধনার দ্বারা জীবের আত্মা সর্বোৎকৃষ্ট অবস্থা বা বুদ্ধপদ লাভ করে থাকে।

বৌদ্ধ ধর্মে দেহভঙ্গ তাৎপর্য:

দেহভঙ্গ ছাড়া সম্পূর্ণ নির্বাণ-প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নেই, কিন্তু ইহলোকেও মানুষের একরকমের নির্বাণ লাভ করবার অধিকার রয়েছে। অতীতের বৌদ্ধ শাস্ত্রকারেরা জানিয়েছিলেন যে, গৌতম নিজেই সেই নির্বাণ লাভ করেছিলেন। শুধুমাত্র ধ্যানই সেই অবস্থা লাভ করবার একমাত্র উপায়। সেই অবস্থায় রাগ, দ্বেষ, স্নেহ, মায়া ইত্যাদি সমস্ত কিছুই, অর্থাৎ — মনের সমস্ত ভাবই নষ্ট হয়ে যায়; তখন যেমন মনের কোন রকমের ভাব-জ্ঞান থাকে না, তেমনি সমস্ত ভাবের অভাবজ্ঞানও থাকে না। চর্যাপদের কবি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ সেই অবস্থাকেই বলেছেন —

“ভাব ণ হোই অভাব ণ জাই

অইস সংবোহে কো পতিয়াই।”

(চর্যা: ২৯)

এখানে যে কথাটা বিশেষভাবে মনে রাখবার দরকার রয়েছে, সেটা হল যে — হীনযানী এবং মহাযানীদের মধ্যেকার যে মতবিরোধ — সেটা কিন্তু বুদ্ধদেব প্রদত্ত কোন ধর্মোপদেশ নিয়ে ছিল না। তাঁদের মধ্যেকার কলহটা আসলে সেই উপদেশগুলিকে পালন করে জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলবার সাধনপন্থা নিয়ে ছিল। হীনযানীরা তাঁদের সাধনার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে নির্বাণ লাভ করাকেই নিজেদের লক্ষ্যে পরিণত করেছিলেন; তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে — সেই নির্বাণ বুদ্ধনির্দেশিত পথেই আসবে; কিন্তু সেই পথটি হচ্ছে — ধ্যান এবং অন্যান্য নৈতিক আচার-আচরণের অতি নিষ্ঠাপূর্ণ সাধনার পথ। সেখানে সাধককে শূন্যতার সাধনা করতে হবে, যে শূন্যতা অস্তিত্বকে অনস্তিত্বে মিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে বা বিলুপ্ত করবার মধ্যে পাওয়া যাবে।

(পরবর্তী ভাগে Part – 3)

Leave a Comment