AHS

বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র ও পালি ভাষার ইতিহাস (Part – 4)

বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র ও পালি ভাষার ইতিহাস (Part – 4)

কলচ্ক্রযান সক্রান্ত তথ্য:

বজ্রযানেরই অন্য একরকমের সাধনপন্থার নাম হলকালচক্রযান। এই যানের সাধকেরা মনে করতেন যে, শূন্যতা এবং কালচক্রএক এবং অভিন্ন। ভূত, বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে অবিরাম প্রবহমান কালস্রোত চক্রাকারে ঘূর্ণমান। এই কালচক্র সর্বদর্শী সর্বজ্ঞ; এই কালচক্রই আদিবুদ্ধ এবং অন্যান্য সমস্ত বুদ্ধের জন্মদাতা। প্রজ্ঞা এবং কালচক্র একত্রে মিলিত হয়ে এই জন্মদান কার্যটি সম্পন্ন করে থাকেন। কালচক্রের এই অবিরাম গতিকে নিরস্ত করা, অর্থাৎনিজেদেরকে সেই কালপ্রবাহের ঊর্ধ্বে উন্নীত করাই কালচক্রযানীদের উদ্দেশ্য এবং সাধনার মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কালকে কিভাবে নিরস্ত করা সম্ভব? কালের গতির লক্ষণ হচ্ছে একের পর এক কার্যের মালা; কার্যপরম্পরা, অর্থাৎগতির বিবর্তন দেখেই মানুষ কালের ধারণায় উপনীত হয়। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই কার্যপরম্পরা মূলতঃ প্রাণক্রিয়ার পরাম্পরা, কাজেই প্রাণক্রিয়াকে নিরস্ত করতে পারলেই কালকে নিরস্ত করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে কালচক্রযানীরা বলেছিলেন যে, যোগসাধনার মাধ্যমে মানব দেহের মধ্যেকার নাড়ী এবং নাড়ীকেন্দ্রগুলিকে আয়ত্ত করতে পারলেই, অর্থাৎপঞ্চবায়ুকে আয়ত্ত করতে পারলেই প্রাণক্রিয়াকে নিরুদ্ধ করা সম্ভব, এবং সেটার ফলেই কাল নিরস্ত হয়ে যায়। এখানে যে জিনিসটা লক্ষ্য করবার দরকার রয়েছে, সেটা হল যেকালকে নিরস্ত করাই যখন মূল উদ্দেশ্য, তখন কালচক্রযানীদের সাধনপদ্ধতিতে তিথি বার নক্ষত্র রাশি যোগ প্রভৃতির একটা বড় জায়গা থাকাটাও স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। আর সেজন্যই অতীতে কালচক্রযানীদের মধ্যে জ্যোতিষ এবং গণিত বিদ্যার চর্চা বেশি ছিল। পণ্ডিতেরা বলেন যে, তিব্বতী ঐতিহ্যানুসারে কালচক্রযানের উৎপত্তি ভারতের বাইরে সম্ভল নামের কোন এক জায়গায় হয়েছিল, এবং পাল রাজাদের রাজত্বকালের কোন একসময়ে এটি বঙ্গদেশে আমদানি করা হয়েছিল। অভয়াকর গুপ্ত কালচক্রযান সম্পর্কে কয়েকটি অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান এবং যোগসাধনা

বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান ইত্যাদি সমস্ত যানগুলির সবই যোগসাধনার ওপরে নির্ভরশীল; যোগাচার মধ্যমিক দর্শনের ভিত্তির ওপরেই এগুলির সবকটির মূল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অতীতের পণ্ডিতেরা দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই তিনটি যান মূলতঃ একই ধ্যানকল্পনা থেকে এসেছিল এবং ব্যবহারিক সাধনার ক্ষেত্রে এই তিনটি যানের মধ্যে পার্থক্যও মূলতঃ খুব একটা বেশি কিছু ছিল না। অতীতে এমন ঘটনাও ঘটেছিল যে, একই সিদ্ধাচার্য একাধিক যানের ওপরে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মের যানগুলির ইতিহাস থেকে অন্য যে জিনিসটি লক্ষ্য করবার বিষয়, সেটা হল যেএইসব বিভিন্ন যানের উৎপত্তি যেখানেই হয়ে থাকুক না কেন, প্রাচীন বঙ্গদেশের মাটিতেই এগুলি লালিত পালিত হয়েছিল। বিভিন্ন যানপন্থী বাঙালী সিদ্ধাচার্যরাই এইসব বিচিত্র গুহ্য সাধনার সাধনপদ্ধতি নিয়ে একাধিক গ্রন্থে আলোচনা করেছিলেন।বৌদ্ধ দর্শন, শাস্ত্র ও পালি ভাষার ইতিহাস (Part - 4)

যে যোগের ওপরে এই তিনটি যান মূলতঃ নির্ভরশীল, সেই যোগহঠযোগনামে পরিচিত, এবং সেটা মানবদেহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শারীরিক জ্ঞানের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। মানবদেহের নাড়িপ্রবাহ, নাড়ির ঊর্ধ্বমুখী গতি, বিভিন্ন নাড়ির সংযোগকেন্দ্র, সেগুলির উৎপত্তিস্থল, নাড়িচক্র প্রভৃতি সমস্তই এই শারীরিক জ্ঞানের অন্তর্গত। বৌদ্ধদের মতেললনা, রসনা এবং অবধূতিএই তিনটিই হল মানবদেহের প্রধান নাড়িপ্রবাহ। এগুলির মধ্যে অবধূতির গতি ঊর্ধ্বমুখী সেটা ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। নিজের দেহের নাড়িপ্রবাহের গতিকে সাধক স্বেচ্ছায় চালনা করতে পারেন এবং সেই চালনার শক্তি অনুযায়ী সাধকের বোধিচিত্তের ধ্যানদৃষ্টি উন্মীলিত প্রকাশিত হয়। এর সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের যোগসাধনার খুব বেশি কিছু পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় না। গবেষকদের মতে উক্ত ললনারসনাঅবধূতি আসলে ব্রাহ্মণ্য যোগতন্ত্রের ইড়াপিঙ্গলাসুষুম্না ছাড়া অন্য কিছুই নয়।

গুরু বা সাধনপথনির্দেশক পরিচালক:

বজ্রযান সাধনপদ্ধতির অপরিহার্য অঙ্গ ছিলেন। সেইসব গুরুরা, সাধনপথের কোন মার্গে শিষ্যের স্বভাবগত প্রবণতা রয়েছে, সেকথা গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে তবেই কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। সেই বিচারপদ্ধতিকে বলা হত — ‘কুলনির্ণয়পদ্ধতি। ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী, এবং ব্রাহ্মণীএই পাঁচটি কুল হল প্রজ্ঞার পাঁচটি রূপ। ভৌতিক মানবদেহ আবার পাঁচটি স্কন্ধ, যথারূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, বিজ্ঞান, এবং সংস্কারএগুলির সারোত্তম দ্বারা গঠিত। যে সাধকের মধ্যে যে স্কন্ধটি বেশি শক্তিশালী বা সক্রিয় থাকত, সেই অনুযায়ী তাঁর কুল নির্ণয় করা হত, এবং তাঁর সাধনপন্থাও সেই অনুসারে ঠিক করা হত। গুরুই সেসব ঠিক করে দিতেন বলে কোন প্রকৃত গুরু ছাড়া বজ্রযান সাধনা অচল ছিল।

বজ্রযান সাধনায় দেবদেবীর স্থান:

বজ্রযান সাধনায় দেবদেবীর স্থানও অপরিহার্য ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে, বজ্রযানে সাধক স্থিতনিষ্ঠ হওয়ার পরে তাঁর ধ্যানচক্ষুতে এক একটি দেবদেবী জন্ম নেন, এবং তাঁরা তাঁদের নির্ধারিত মণ্ডলে আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এইসব দেবদেবীদের মধ্যেহেবজ্র, বজ্রসত্ত্ব, হেরূক, মহামায়া, বজ্রভৈরব, কুরুকুল্লা, হেবজ্রোদ্ভবইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অতীতের বাঙালী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরাবজ্রযোগিনী, সিদ্ধবজ্রযোগিনী, বজ্রধরএইসব দেবদেবীর স্তুতিগান করে খৃষ্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তবে সেগুলির মধ্যে অধিকাংশই বর্তমানে হয় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, অথবা আজও অপরিজ্ঞাত রয়েছে; সেগুলোর থেকে সামান্য কিছুমাত্র ঐতিহাসিকদের হাতে এসে পৌঁছেছে।

হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের সদৃশ্যতা:

আপাতদৃষ্টিতে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মের কোন মিল না থাকলেও গৌতমবুদ্ধ প্রচারিত ধর্মমত এবং জীবনদর্শন কিন্তু পুরোপুরিভাবে হিন্দুশাস্ত্রের প্রভাব বর্জিত হতে পারেনি। বুদ্ধদেব মানবজীবনের বিভিন্ন দুঃখ এবং সেসব থেকে মানুষের মুক্তির পথকেই নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন। মনুষ্য জীবনের এই দুঃখ এবং যন্ত্রণার কথাপ্রাচীনযুগের ভারতের মুনিঋষিদেরও অগোচরে ছিল না। এই প্রসঙ্গে উপনিষদে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, এই পৃথিবীকে মায়াময় জেনে ব্রহ্মপদে প্রবেশ করতে পারলে তবেই জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা এবং দুঃখভোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রাচীন ভারতের ঋষিরা আরও জানিয়েছিলেন যেজগৎ অনিত্য, এবং সেই অনিত্য জগৎ থেকে সৃষ্টি হওয়া মোহ এবং অবিদ্যাই মানুষের দুঃখভোগের মূল কারণ; এবং সেই মোহ অবিদ্যা মিথ্যাকে ধ্বংস করতে পারলে তবেই মোক্ষলাভ করা সম্ভব। হিন্দুশাস্ত্রের এই মোক্ষের ধারণার সঙ্গে বুদ্ধদেবের নির্বাণতত্ত্বের কোন অমিল দেখতে পাওয়া যায় না। মোক্ষলাভ করবার রাস্তা নিয়েই দুই ধর্মের যা কিছু প্রভেদ দেখা যায়। জপ, তপ, পূজার্চা, মন্ত্র, বলিদানএইসব বাইরের আচার আচরণ দিয়ে কি মোক্ষলাভ করা সম্ভব, নাকি যাগযজ্ঞ বাদ দিয়ে আত্মতত্ত্ব সম্পর্কে অবগত হলেই মুক্তি পাওয়া যাবে, কিংবা শৃঙ্খলার সঙ্গে কাম অর্থ ইত্যাদিকে সম্ভোগ করলে মোক্ষ পাওয়া যাবেগৌতম বুদ্ধের জন্মের বহু আগেই প্রাচীন হিন্দু দার্শনিকেরা এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। বুদ্ধদেব অবশ্য হিন্দু ধারণাপরমাত্মা থেকে মায়ার যোগে জীবাত্মার এবং নানারকমের মোহের সৃষ্টি, আবার সেই মোহজালকে ছিন্ন করতে পারলেই জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে মুক্তি লাভ করতে পারেএই বিষয়টিকে স্বীকার করতেন না। এর পিছনে প্রধান কারণ ছিল যে, তিনি জীবাত্মা এবং পরমাত্মায় বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু মানবজীবনের দুঃখের প্রধান কারণ যে অবিদ্যা বা মোহহিন্দুদের এই ধারণার সঙ্গে তিনিও একমত ছিলেন। বুদ্ধদেব বলেছিলেন যে, মানুষের ভবিষ্যৎ তাঁর নিজের কর্মের দ্বারা গঠিত হয়, কর্মসমষ্টিইরূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার বিজ্ঞানএই পঞ্চঋদ্ধ অবলম্বন করে জন্মজন্মান্তরে রূপায়িত হয়ে উঠছে, আর এই কর্মের কারণ থেকেই প্রত্যয়ীভূত জগতের উদ্ভব ঘটেছে। এই যে কর্মবশ্যতা, সেটাই হল অবিদ্যা, এবং সেটার থেকেই আধ্যাত্মিক আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক দুঃখের সুত্রপাত বৃদ্ধি ঘটে থাকে। তাই, মানুষ যদি অবিদ্যার বশীভূত না হয়, সে যদি জাগতিক, অর্থাৎমিথ্যা কামনা বাসনা ত্যাগ করতে পারে, তাহলেই সে নিজের দুঃখ নিরোধ করতে সক্ষম হবে এবং এভাবেই সে নির্বাণ লাভ করতে পারবে।

(পরবর্তী ভাগে সমাপ্ত, Part – 5)

 

Leave a Comment